
বাংলাদেশের
চিকিৎসকদের প্রতি সীমাহীন অভিযোগ প্রায়ই চোখে পড়ে। অবশ্যই আর সব পেশার মতো চিকিৎসক
পেশার মাঝেও অসৎ ও লোভীরা আছে তবে তারাই সংখ্যাগুরু নয়। আমাদের ঘরের কোনে পড়ে থাকা বিভিন্ন উপাদানের মাঝে
নানান রোগের উপশম আছে। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে এমন অনেক ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়মত ব্যবহৃত
হয়ে থাকে যা আমাদের দেশের নানি দাদীরা যা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে এসেছেন। সেসব চিকিৎসার
অনেকাংশ আজও কার্যকর! অতি সাধারন আর সামান্য অসুস্থতায় কিছু সহব্লগারের তিক্ত অভিজ্ঞতা জেনে দীর্ঘ দিন ধরেই মনে হয়েছে ছোটখাটো রোগের কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা জানা থাকলে হয়তো তাঁদের এমন হেনস্থা হতে হতোনা। আর সেই ভাবনা থেকে এই পোস্টের অবতারনা....
জ্বর:
খুব সাধারন অসুস্থতা।
সাধারন জ্বর বলতে ভাইরাল ইনফেকশন বা ঠান্ডা/শীতের কারনে যে জ্বর আসে তা বুঝায়। আমাদের
দেশে অধিকাংশ মানুষ শুরুতে প্যারাসিটামল দিয়েই জ্বরের প্রাথমিক চিকিৎসা করে থাকেন।
প্যারাসিটামল যদি
গ্রহন করতেই হয় তবে শরীরের তাপমাত্রা ১০২ এর বেশী হলে ভরপেটে খাবার খেয়ে প্রচুর পানির
সাথে প্যারাসিটামল গ্রহন করা উচিৎ। জ্বর মানেই কাঁথা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকা এমন ধারনা
আমাদের মাঝে বিরাজ করে। জ্বরের সময় বিশ্রাম জরুরী তবে তা কাঁথা কম্বল বা গরম কাপড় পেঁচিয়ে
নয় বরং এমন সময় যথা সম্ভব হাল্কা পোশাক পড়ে ঘর স্বস্তিকর ঠান্ডা তাপমাত্রায় রাখা উচিৎ।
এতে জ্বর কমে যেতে সাহায্য করে। জ্বর মানেই গোসল নয় এই ধারনা ভুল। হালকা গরম পানিতে
ঘোসল করে চুল ভাবে শুকিয়ে নিলে জ্বরের প্রকোপ কমে যেতে সাহায্য করে। ভেজা চুলে বিছানায়
যাওয়া যাবেনা, এতে ঠান্ডার প্রকোপ বেড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি।
এসময় হাইড্রেশন জরুরী
তাই প্রচুর পানি বা লেবুর সরবত পান করতে হবে। সেই সাথে সামর্থ অনুযায়ি পেয়ারা, আপেলকমলা,
বাতাবি লেবু, আমলকি জাতীয় ফল খাওয়া ভালো।
সতর্কতা:
মনে রাখা জরুরী,
জ্বর নিজে একটি অসুখের চেয়ে একটি লক্ষণ বা সিম্পটম হিসেবে বেশি বিবেচিত হয় তাই ঘরোয়া
চিকিৎসায় ৩-৫ দিনে জ্বরের প্রশমন না হলে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে।
(প্যারাসিটামল জাতীয়
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভয়ংকর হতে পারে তাই এসব ওষুধ যথা সম্ভব এড়িয়ে চলা ভালো)
সর্দি কাশি:
শীত অথবা গরম, সর্দি
কাশি আমাদের খুব পরিচিত একটি অস্বস্তির নাম। ধুলোবালির এলার্জির কারনে যাঁদের এধরনের
লক্ষণ হয়ে থাকে তাঁদের ধুলোবালি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিৎ।
শীত বা ভাইরাল কারনে
সর্দিকাশি হলে সবচেয়ে জরুরী পথ্যটির নাম মধু। পাশ্চাত্যের দেশেও এই অতি প্রাচীন ঘরোয়া
চিকিৎসা সর্দি কাশির জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। আমাদের দেশে অনেকে মধুর সাথে লেবুর রস আবার
কেউ সেই সাথে তুলসী গ্রহন করেন যা এধরনের অস্বস্তি প্রশমনে সাহায্য করে।
এলার্জির ক্ষেত্রে
কাঁচা হলুদ বা কাঁচা হলুদের রস গ্রহন করে উপকার পাওয়া যায়।
অস্বস্তিকর সর্দি
নিরাময়ে প্রায় ১০০% নিশ্চয়তা দেয় মধু আর রসুন। কাঁচা রসুনের কোয়া মুখে রেখে কিছুক্ষণ
পর পর দাঁত দিয়ে সামন্য কেটে নির্যাস বের করতে হবে। রসুনের উৎকট গন্ধ সহ্য করে দিনে
৩-৪ বার রসুনের কোয়া এমনি ভাবে গ্রহন করলে সর্দির অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাবার সম্ভাবনা।
সর্দিকাশির সময় কালোজিরা
আরোগ্যলাভে অনেক সাহায্য করে।
সতর্কতা: কাশির সাথে
রক্তক্ষরণ হলে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে।
নাক বন্ধ:
সর্দির মতোই বিরক্তিকর
ঠিক এর বিপরীত অর্থাৎ নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে একটি পাত্রে পানি ফুটতে দিয়ে সেখানে
অবস্থান করলে কিছুক্ষণের মাঝেই এর উপশম ঘটে তবে তা আবার ফিরে আসতে পারে। এক্ষেত্রে
নিশ্চিত করা জরুরী যেকোন কক্ষে অবস্থানের সময় কক্ষটি যেনো শুষ্ক না হয় এবং যথেষ্ট হিউমিড
থাকে।
খুসখুসে কাশি:
খুব কমন আর অস্বস্তির
এই কাশি। অনেকের নিজের ও পরিবারের রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এমন কাশিতে। ধুমপানের অভ্যাস
থাকলে এমন কাশি হলে তা সাথে সাথে ত্যাগ করা জরুরী, এমনকি ধুমপায়ী ব্যক্তির পরিবারের
কারো এই কাশি হলে ধুমপানে সতর্ক হওয়া জরুরী।
এক্ষেত্রেও মধু বেশ
ভালো কাজ করে। একটি পাত্রে পানি ফুটতে দিয়ে সেখানে কিছুক্ষন অবস্থান করলে এর প্রশমন
হতে পারে। রাতে ঘুমানোর সময় ঘরের হিউমিডিফায়ার রাখা জরুরী(এটা শীতের দেশের ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য)। রুম হিটার/ভেন্ট এর পাশে একটি বাটিতে পানি রেখে হিউমিডিফায়ারের কাজ চালিয়ে
নেয়া যায়।
গলা বসে যাওয়া:
আমাদের প্রায়ই কোন
না কোন কারনে গলা বসে যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরী চিকিৎসা মৌনতা। কথা বলা যথাসম্ভব
বন্ধ রেখে ভোকাল কর্ডকে বিশ্রাম দিতে হবে। একটি মগে প্রায় ফুটন্ত পানি নিয়ে তা চারপাশ
দিয়ে ঢেকে নিরাপদ(যেনো মুখের ত্বক বা নাসারন্ধ্রে প্রবেশ না করে) দুরত্ব রেখে ভাপটা
মুখ হা করে টানতে হবে যেনো গলার কাছে উষ্ণতা অনুভূত হয়। এটা অনেকটা ভোকাল কর্ডকে গরম
শেক দেবার মতো। এই প্রক্রিয়ার পরও পুরোপুরি সুস্থা না হওয়া পর্যন্ত বাক্যালাপ যথা সম্ভব
কম করা উচিৎ।
এসময় ঠান্ডা পানীয়,
বরফ বা আইসক্রীম জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
ডাইরিয়া:
আমাদের দেশের এক
মরনব্যাধি। গ্রীষ্মের প্রখর তাপদাহে আর বর্ষার মৌসুমে আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠে।
ডাইরিয়ার চিকিৎসায়
এক জগ পানিতে এক চিমটি লবন, আর এক মুঠো গুড়ের মিশ্রনের ফর্মুলা শৈশব থেকে আমরা জেনে
আসছি। এই মিশ্রন ডাইরিয়ার কারনে শরীরে সৃষ্ট পানি শুন্যতা আর ইলেকট্রোলাইটের ঘাটতি
পূরন করে। অনেক ক্ষেত্রে এর চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে তবে যেহেতু অধিকাংশ
ক্ষেত্রে রোটা ভাইরাসের সংক্রমনের কারনে ডাইরিয়া হয়, এ্যান্টোবায়োটিক খুব কাজে আসেনা।
রোগের শুরুতেই একটু
সচেতন হলে ডাইরিয়ার প্রকোপ কমিয়ে দ্রুত আরোগ্য লাভ সম্ভব।
ডাইরিয়া হয়েছে এমন
জানার সাথে সাথেই দই খাওয়া ভালো। অনেকে আকাশ থেকে পড়বে এমনটা শুনে তবে দইয়ে থাকে প্রোবায়োটিক
যা আমার অন্ত্র ও পাকস্থলীর ভালো ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি করে ডাইরিয়ার জীবানুর
সাথে লড়াইয়ে শক্তিশালি করে তুলে। সেই সাথে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ লেবু অথবা কমলা জাতীব
খাবার খাওয়া ভালো, এমনকি আমলকি। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে পুরো ফল না দিয়ে লেবু বা কমলার
রস দেয়া যায় তবে মনে রাখতে হবে বাজার থেকে কিনে আনা জুস নয়; টাটকা ফল কিনে ভালো করে
ধুয়ে রস বের করে তা দিতে হবে। ডাইরিয়া হলে সাদা ভাত, ময়দার রুটি খাওয়া ভালো। আর এই
সব কিছুর সাথে আমাদের অতি পরিচিত খাবার স্যালাইন আছেই।
ডায়রিয়ায় অনেক সময়
বমির প্রকোপ দেখা যায়। এক্ষেত্রে বমির পর এক থেকে দু ঘন্টা কোন খাবার গ্রহন না করে
তার পর পরিস্কার চামচে এক চামচ দই মুখে দিয়ে ১৫-২০ মিনিট পর্যবেক্ষণ করতে হবে আবার
বমি হয় কিনা। বমি নাহলে ১৫-২০ মিনিট পর আবার এক দুই চামচ দই খেয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ
করতে হবে। পরবর্তিতে সাদা ভাত অল্প গ্রহন করা যেতে পারে। বমি হলে একই ভাবে বিরতি দিয়ে
পপসিকল বা আমাদের দেশের ললি আইসক্রিম(ভালো ও নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ডের) গ্রহন করলেও
উপকার পাওয়া যায়।
সতর্কতা: মনে রাখতে
হবে ডাইরিয়ার সাথে ১০১+ জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হলে, মল বা বমির সাথে রক্ত ক্ষরণ হলে অতি
স্বত্ত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ছোটখাটো আঘাত পাওয়া:
পরিবারের ছোট বড়
সকলেই কোন না কোন সময় আঘাত পেয়ে থাকে। ছোটরা খেলার সময় মাথায় আঘাত পেয়ে মাথে ফুলে গেছে,
এটা বেশ নৈমিত্তিক ঘটনা। মাথা, হাত, পা যেকোন স্থানে আঘাত পেয়ে ফুলে যাওয়া রোধ সম্ভব
যদি আঘাতে সাথে সেখানে বরফ দেয়া যায়। বরফ সরাসরি না দিয়ে কাপড়ে পেঁচিয়ে আঘাতে স্থানে
১৫/২০ সেকেন্ড ধরে রেখে একটু আবার বরফ দিতে হবে যতোক্ষন ব্যাথা কমে না যায়।
"হট এন্ড কোল্ড
জেল প্যাক" সহজলোভ্য হলে তা ফ্রীজে বরফ করে রাখলে এসব ক্ষেত্রে খুব কাজে আসে।
সতর্কতা:
মাথায় প্রচন্ড আঘাত
পেলে বা মাথায় যেকোন আঘাতের ২-৩ ঘন্টার মাঝে নিচের লক্ষণ পরিলক্ষিত হলে অতি স্বত্ত্বর
চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
১) দৃষ্টি ঝাপসা
হয়ে আসা
২) নাক বা কান দিয়ে
রক্তপাত (সামান্য রক্তপাত হলেও তা ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণ)
৩)কথা জড়িয়ে আসা
৪)বমি হওয়া
৫)হাঁটাচলা অস্বাভাবিক
হওয়া
**এক্ষেত্রে যেসব
হাসপাতালে সিটি স্ক্যান করার সুবিধা আছে সেখানে যাওয়া ভালো।
ছোট খাটো পুড়ে যাওয়া:
রান্না ঘরে কাজ করতে
গিয়ে তেলের ছিটা পড়ে হাত পুড়েনি এমন রাধুনি বিশ্বের প্রায় কোথাও নেই। সেক্ষেত্রে কাঁচা
ভালো ভাবে ধুয়ে কিছু অংশ কেটে চাকু বা নখ দিয়ে খুঁচিয়ে আলুর নির্যাস বের করে পড়ে যা্ওয়া
স্থানে লাগালে জ্বলন টা কমে যায় সেই সাথে ক্ষতর দাগ দীর্ঘস্থায়ী হয়না এমনটা দেখেছি।
সতর্কতা: পুড়ে যাওয়া
ক্ষত দেড় ইন্চির বেশি হলে শুধুমাত্র ঘরোয়া চিকিৎসার উপর নির্ভর না করা ভালো।
হেঁচকি:
কোন রোগ নয় তবে অতি
বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা। হেঁচকির সময় জীভের উপর কিছুটা চিনি রেখে দিলে দ্রুত হেঁচকি বন্ধ
হয় এমন দেখেছি যদিও এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানা নেই। চিনি না চাইলে শ্বাস গ্রহন করে
নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে পেটটা ফুলিয়ে আবার নামিয়ে আবার ফুলাতে হবে - এমন কয়েকবার করলে হেঁচকি
বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ডায়াফ্রামের পেশীর এক্সারসাইজ হয় যা সাধারনত হেঁচকির কারন
বলে মনে করা হয়।
পেসাবে জ্বালাপোড়া:
পেসাবে জ্বালাপোড়া
সেই সাথে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর ইউরানারী ট্রাক্ট ইনফেকশনের লক্ষণ। এসময় প্রচুর পানি পান
আর ভিটামিন সি জাতিয় ফল খাওয়া জরুরী। সাধারণ অবস্থায় দিনে পাঁচ লিটার পানি পানের নিয়ম,
এমন হলে ৬-৭ লিটার পান করা জরুরী। লক্ষনের শুরুতে এই ঘরোয়া চিকিৎসায় কাজ হতে পারে তবে
তা দুদিনের বেশী দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রে এসময়
জ্বরের প্রকোপ খুব বেশি না হতে পারে আবার অনেক সময় পিঠে ব্যাথা হতে পারে, এসব ক্ষেত্রেও
প্রচুর পানি পান ও ভিটামিন সি জাতিয় ফল কাজে আসে। এমনকি চিকিৎসক এন্টিবায়োটিক দিলেও
পানি ও ভিটামিন সি গ্রহন দ্রুত নিরাময়ে সাহায্য করে।
মন্তব্য
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন