গত
শতাব্দীর ’৮০-র দশক থেকে শুরু হওয়া গার্মেন্ট শিল্পের রাতারাতি এতটাই বিকাশ হয় যে
ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গার্মেন্ট শিল্প গড়ে
উঠেছে। বিজিএমইএ সূত্র মতে তাদের তালিকাভুক্ত গার্মেন্টসের সংখ্যাই ৫ হাজার ৬শ’।
তাতে শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। ছোট-বড় মিলিয়ে আরো অনেক বেশি গার্মেন্টস
কারখানা রয়েছে। এই শ্রমিকদের শতকরা ৮০ জনই হচ্ছেন নারী শ্রমিক।
সাম্রাজ্যবাদের সস্তা শ্রম লুণ্ঠন এবং মালিকদের অতি মুনাফা অর্জনের যাঁতাকলে
শ্রমিকরা পিষ্ট হচ্ছেন। রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শতকরা ৭৬ ভাগ আসে এই
গার্মেন্টস শিল্প থেকে। কিন্তু শ্রমিকদের জীবন চলে নির্মম দুর্বিসহ অবস্থায়।
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় শ্রমিকদের দৈন্যদশা পৃথিবীর দেশে দেশে থাকলেও
বাংলাদেশের শ্রমিকদের, বিশেষতঃ গার্মেন্টস শিল্প শ্রমিকরা প্রায় মধ্যযুগীয় দাস
প্রথার মধ্যেই রয়ে গেছেন। বুর্জোয়াদের দ্বারা স্বীকৃত আইনও গার্মেন্টস মালিকরা
মানছে না। বুর্জোয়া আইনের সুবিধাগুলো থেকেও গার্মেন্টস শ্রমিকরা বঞ্চিত।
তারা বেতন-ভাতা ঠিকমত পাচ্ছেন না। ২৪ নভেম্বর, ’১২-এ আগুনে পুড়ে নিহত-আহত তাজরীন
গার্মেন্টের শ্রমিকদের ৩ মাসের বেতন-ওভার টাইম বকেয়া ছিল। ২৪ নভেম্বরের পর টানা ১০
দিন আন্দোলন-সংগ্রামের পর বিজিএমইএ মাত্র ১২/১৩ শত শ্রমিকের বেতন-ভাতা দিয়েছে।
বাকিদের দিব, দিচ্ছি বলে টালবাহানা করছে। এই শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ছুটি, মেডিক্যাল
ছুটি দেয়া হয় না। অসুস্থতাজনিত বা অন্য কোন অনিবার্য কারণে একদিন হাজির না থাকলেও
বেতন কেটে নেয়। এবং হাজির না থাকার কারণে বেতন আটকে রাখে। স্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয়
না। বিশেষ কোনো কারণে কোনো শ্রমিক পরপর কয়েকদিন হাজির না থাকলে ছাঁটাই করে অথবা
নতুন করে নিয়োগ দেয়, যাতে পুরনো শ্রমিকের সুবিধা (ঈদ বোনাস ইত্যাদি) ভোগ করতে না
পারে। রাত ৮/১০টা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য হলেও খাতায় হাজিরা তোলে সন্ধ্যা ৭টা
পর্যন্ত। এটা করে বিদেশী বায়ারদের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য। বাস্তবে বিদেশী বায়াররাও
যে এই ফাঁকিবাজী জানে না বা বোঝে না তা নয়। দেশী বিদেশী মিলেই তারা এভাবে আইন
‘মেনে’ চলে। মালিকদের ইচ্ছা-খুশিমত ছাঁটাই করে, ছাঁটাই করার সময় পাওনা বেতন-ভাতা
দেয়া হয় না। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয় না অধিকাংশ গার্মেন্টসে।
প্রসবকালীন তাদের চাকরী হারাতে হয়। অধিকাংশ কারখানায় সন্তান প্রতিপালনের জন্য কোনো
ডে-কেয়ার সেন্টার নেই। ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের স্বীকৃতি থাকলেও গার্মেন্টস শ্রমিকদের
শ্রম করতে হয় দৈনিক ১২/১৪/১৬ ঘণ্টা। এ ছাড়া হোল নাইটও করতে হয় বাধ্যতামূলক। ওভার
টাইম মজুরী দ্বিগুণ করার আইন থাকলেও তা দেয়া হয় না।
মালিকরা শ্রমিক শোষণ করে টাকার পাহাড় গড়লেও গার্মেন্টসে শ্রমিকদের জন্য কোনো
সুব্যবস্থা নেই। ভাত খাওয়ার ভাল কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক গার্মেন্টসে ছাদে বা
সিঁড়িতে বসে খেতে হয়। ডিউটি শেষে নারী শ্রমিকদের অসম্মানজনকভাবে চেক করা হয়।
শ্রমিকদের কারখানার প্রত্যেক তলায় কলাপসিবল গেটে তালাবন্ধ করে রাখা হয়। জরাজীর্ণ
বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, সন্ধ্যার সময় থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে চাপ বেড়ে যাওয়ায় অধিকাংশ
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা রাতেই ঘটে থাকে। রাতে আগুন লাগা, গেট বন্ধ থাকা, অপ্রশস্থ
সিঁড়ি, খরচ বাঁচানোর জন্য দুর্বল বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে, অর্থাৎ
অব্যবস্থাপনার কারণেই প্রায় ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এবং বহু শ্রমিক আগুনে
পুড়ে আহত-নিহত হন। মালিক এবং সরকারের এর জন্য কোনো দায় নেই। ভবন ধ্বসে, আগুনে পুড়ে
শতশত শ্রমিকের মৃত্যু হলেও এ পর্যন্ত কোনো মালিকের শাস্তি পেতে হয়নি।
গার্মেন্টস ব্যবসার শুরুতেই নিুতম মজুরী ছিল ২৫০/৩০০ টাকা। বছরে বছরে দ্রব্যমূল্য
বৃদ্ধি পেলেও গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরী বহু আন্দোলন ছাড়া কখনই বাড়ে না।
আন্দোলনের চাপে গত তিন দশকে কয়েক দফা মজুরী বেড়ে নিুতম মজুরী এখন দাঁড়িয়েছে ৩
হাজার টাকায়। প্রত্যেকবারই শ্রমিকরা আন্দোলন করে বুকের রক্ত ঢেলে মজুরী বৃদ্ধি
করতে মালিকদেরকে বাধ্য করেছে। ২০১০ সালে যে মজুরী কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে সেই
নিুতম মজুরীও ঠিকমত দিচ্ছে না মালিকরা। শিক্ষানবিশ হিসেবে ৩-৬ মাস পর্যন্ত
২৫০০টাকা করে মজুরী দেয়া হয়। যেসব শ্রমিক পুরনো মজুরী কাঠামোতে তৃতীয় গ্রেডে বেতন
পেতেন তাদেরকে ৪র্থ বা ৫ম গ্রেডে বেতন দেয়া হচ্ছে। ওভার টাইমের ভাতা কমিয়ে দিচ্ছে।
নাইট বিল কমিয়ে কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বলছে যত সময় লাগুক কাজ করতে হবে,
টার্গেট পূরণ করতে হবে। এর জন্য মালিক অতিরিক্ত মজুরী দিচ্ছে না। নতুন মজুরী
কাঠামো বাস্তবায়নের নামে শ্রমিকদের উপর শোষণ-নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
অনেক কারখানায় হাজিরা বোনাস, বিশেষ ভাতা, পারদর্শী ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা
দিত। বর্তমানে সেগুলো কমিয়ে দেয়া হয়েছে, বেশির ভাগ কারখানায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
শ্রমিকদের সর্বশেষ বেতন বাড়ানোর ছয় মাসের ব্যবধানেই ডলার মূল্যে শ্রমিকদের বেতন
কমেছে। জুলাই, ’১০-এ ১ ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৬৯ টাকা ৫০ পয়সা, কিন্তু
ফেব্র“য়ারি, ’১১-তে এসে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ টাকা ১৯ পয়সা। অর্থাৎ জুলাই, ’১০-এ
যে বেতন ছিল ৪৩ ডলার ছয় মাস পরেই সেটি কমে ৪২ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এখন সেই ডলার ৮৫
টাকা প্রায়। অন্যদিকে মজুরী বৃদ্ধির পর থেকেই অস্বাভাবিকভাবে নিত্যপণ্যের
মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাস্তবে মজুরী পূর্বের চেয়েও কমে গেছে। গার্মেন্ট মালিকরা
শ্রমিকদের বাসস্থানের কোন ব্যবস্থা না করায় বাড়ী-মালিকরা দফায় দফায় বাসা-ভাড়া
বাড়িয়ে শ্রমিকদের বর্ধিত মজুরীর বড় অংশই আত্মসাৎ করে নিয়েছে। এভাবে মজুরী বৃদ্ধি
শ্রমিকদের কোন কাজেই লাগেনি। অন্যদিকে বিবিধভাবেই নিুতম মজুরী ৩ হাজার টাকা করা
হলেও শ্রমিকরা অনেকেই পাচ্ছেন তারও কম। এভাবে মালিক সমিতি বিজিএমইএ এবং শ্রম
মন্ত্রণালয় এক প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। এসব অভিযোগ শ্রমিক নেতারা মালিকদের সংগঠন
বিজিএমইএ এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ে জানালেও এর প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা সরকারপক্ষ
নেয়নি।
২০১০-এর জুলাই-এ যে মজুরী কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে তা বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে
কম। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মজুরী প্রতি ঘণ্টায় ৫৫ থেকে ৬৮ সেন্ট। অর্থাৎ বাংলাদেশের
৩৯ টাকা থেকে ৪৮ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরী
প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ১৪ টাকা ৪২ পয়সা। অথচ বাংলাদেশের গার্মেন্টে মালিকদের মুনাফার
হার ৪৩.১০ শতাংশ, কম্বোডিয়ায় ৩১ শতাংশ, ভারতে ১১.৮ শতাংশ, ইন্দেনেশিয়ায় ১০ শতাংশ,
ভিয়েতনামে ৬.৫ শতাংশ, নেপালে ৪.৪ শতাংশ, এবং চীনে ৩.২ শতাংশ। এতে দেখা যায়
বাংলাদেশী মালিকরা অনেক বেশি মুনাফা করলেও শ্রমিকদের সবচেয়ে কম মজুরী দেয়। আর এ
কারণেই শ্রমিকরা মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
২০১০ সালে নতুন মজুরী কাঠামোর পর সরকার দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী
তেলের মূল্য বৃদ্ধি করায় নিত্য পণ্যের মূল্য, বাড়ি ভাড়া, পরিবহন ভাড়া গত আড়াই বছরে
দ্বিগুণ বেড়েছে। যার পরিসংখ্যান এখানে দেয়ার প্রয়োজন নেই। শ্রমিক ও জনতা প্রত্যক্ষ
জীবন থেকেই বুঝতে পারছেন। বস্তিতে ছোট এক রুমের ভাড়া ৩ হাজার টাকার কমে পাওয়া
যাচ্ছে না ঢাকা শহরে। তা-ও ৫/৭টা পরিবার মিলে এক বাথরুম, ১/২টা টয়লেট ব্যবহার করতে
হয়। রাত ৯/১০টায় ঘরে ফিরে রান্না করে খেয়ে রাত ১২টার আগে ঘুমাতে যাওয়ার উপায় নেই।
আবার ভোর ৫টা থেকে লাইন ধরে গোসল, রান্না, খাওয়া সেরে সকাল ৮টার আগে কারখানায়
পৌঁছাতে হয়। ১মিনিট লেট হলেই হাজিরা বোনাস কেটে নেয়া হয়। এরকম ঘর ভাড়া দিতেই ৩
হাজার টাকা চলে যায়। ওভার টাইমের টাকা দিয়ে সারা মাসের খাওয়া, চিকিৎসা, কাপড়
ইত্যাদি খরচ চালাতে হয়। উপরন্তু মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানতো রয়েছেই।
উপায়ান্তর না পেয়ে শ্রমিকরা একরুমে ৪/৫ জন গাদাগাদি করে আলো-বাতাসহীন
দুর্গন্ধযুক্ত ঘরে বাস করেন। কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে অন্যদের দায়িত্ব পালন করেন। এই
কারণেই শ্রমিকরা ওভার টাইম করতে চান। তারা ন্যয্য মজুরী পেলে এই অমানুষিক পরিশ্রম
তারা করতেন না। শ্রমিকদের অনাবিল দাম্পত্য জীবন, বিনোদন বলতে কিছু নেই। ভাড়া
বাড়িতেও শ্রমিকদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। সন্তান-ভাই-বোনদের নিয়ে বাড়ি ভাড়া দিতে
চায় না বাড়িওয়ালারা। তারা তথাকথিত নিরিবিলির জন্য ছোট পরিবার ভাড়া দিয়ে থাকেন।
আগামীতে বাড়ি ভাড়া, দ্রব্যমূল্য আরো বাড়বে, কারণ হাসিনা সরকার আবারো জ্বালানি
তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ছে। তাই, গার্মেন্টস শ্রমিকদের
বর্তমান মজুরীতে কোনো মতেই চলছে না। মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলনে ফের শ্রমিকদের নামতে
হবে। কারণ মালিকরা আন্দোলন ছাড়া বেতন বৃদ্ধি করবে না।
কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন হলে বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে সরকার-মালিক মিলে কোরাসে
গাইতে থাকে এটি উসকানি, নাশকতা, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বলে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব
ব্যবস্থায় পুঁজিপতিরা বা সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশগুলো বাজার দখলের জন্য
নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি এবং ষড়যন্ত্র করে থাকে। কথা হচ্ছে এই ষড়যন্ত্রকারী দেশ ও
ব্যক্তিদের নাম সরকার কখনই প্রকাশ করে না। এবারও তাজরীন ফ্যাশনের শ্রমিক হত্যার পর
প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করেছে। আর এর বলি করা হয়েছে
শ্রমিকদেরই। শ্রমিক সুমি বেগম ও জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে, রিমাণ্ডে
পাঠিয়েছে। রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য কোনো তদন্ত ছাড়াই প্রতিপক্ষ জামাতকে দায়ী
করেছে। মালিকদের রক্ষার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করা হয়।
মালিকদের জানমাল রক্ষা এবং শ্রমিক বিক্ষোভকে দমনের জন্য প্রধান মন্ত্রী ২৪ নভেম্বর
রাতেই ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে। অথচ জীবিত শ্রমিকদের বেতন দিতে, তাদের
ছাঁটাই বন্ধ করতে, তাদের চাকরীর নিশ্চয়তার কোনো ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রী করেনি।
শ্রমিকদের প্রতিটি ন্যায্য আন্দোলন দমনে প্রত্যেক সরকারই এ ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে
থাকে। বুর্জোয়া আইনে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার বিধান থাকলেও মালিকরা সে অধিকার
দিচ্ছে না। ইউনিয়ন করতে গেলে বা কোনো ইউনিয়নের সাথে যুক্ত আছে জানতে পারলে সে
শ্রমিককে ছাঁটাই করে। শ্রমিকদের উপর মালিকদের এই মধ্যযুগীয় শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে
কোনো সরকারই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, নিচ্ছে না। উপরন্তু হাসিনা সরকার শ্রমিক দমনে
ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল পুলিশ গঠন করেছে।
আজকে শ্রমিকদের এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে যে, বুর্জোয়া শ্রম আইন, বুর্জোয়া
আদালত, সরকার, এদের রাষ্ট্রব্যবস্থা মধ্যযুগীয় এই দাসত্ব থেকে তাদের মুক্তি দেবে
না। প্রতিবার মজুরী বৃদ্ধি রক্তাক্ত আন্দোলনের মাধ্যমেই করতে হয়েছে, কিন্তু তাতে
সমস্যার কোনো সমাধানই হচ্ছে না। তাই, শ্রমিক শ্রেণীকে সাম্রাজ্যবাদ, দালাল শাসক
শ্রেণী তথা মালিক শ্রেণীর শোষণ-নির্যাতন-লাঞ্ছনার ব্যবস্থা থেকে মুক্তির জন্য লড়তে
হবে। লড়তে হবে নিজেদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা নেবার জন্য। এবং প্রতিষ্ঠা করতে হবে
পুঁজিবাদের বদলে সমাজতন্ত্র। বুর্জোয়া আইন, বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদের
এবং শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিপ্লবী রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরতে হবে। আশু
দাবি-দাওয়ার আন্দোলন যা নাকি বিপ্লবী রাজনীতিকে সহায়তা করে এমন ধারার ট্রেড ইউনিয়ন
গড়ে তুলতে হবে। যে ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক শ্রেণীর প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করবে। যার
নেতারা টাকার বিনিময়ে মালিকদের, সরকার তথা শাসক শ্রেণীর কাছে বিক্রি হবে না।
শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিগুলো তুলে ধরে লাগাতার সংগ্রাম চালাবে দাবি আদায় না হওয়া
পর্যন্ত। কেবল বিপ্লবী ধারার রাজনীতি, এবং তার সমর্থনে বিপ্লবী ধারার ট্রেড
ইউনিয়নই শ্রমিক শ্রেণীকে মুক্তির দিকে এগিয়ে নিতে পারে।
নানা
ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের সময়
নির্ধারণ ও মজুরির দাবিতে ১৮৮৬ সালে আন্দোলনে নেমেছিলেন। তারা সফলও হয়েছিলেন।
পেয়েছিলেন ৮ ঘণ্টা কাজের স্বীকৃতি। মাঝে পেরিয়ে গেছে ১৩০ বছর। তবে এখনো বাংলাদেশের
নারী পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, নিরাপত্তার দাবিতে রাজপথে নামতে হয়। লিখেছেনÑ রওনক বিথী
১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শ্রমিকরা সে যুগের বৃহত্তর শ্রমিক
ধর্মঘটের আয়োজন করেছিলেন। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর শ্রমিকরা
দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ ও মজুরির দাবিতে এ আন্দোলন করেন। সে সময় আমেরিকা
ও ইউরোপের সর্বত্রই হতভাগ্য শ্রমিকদের ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করাটা ছিল বাধ্যতামূলক।
ওভারটাইম, ছুটিছাটা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ কর্মসংস্থানের নিয়ম-নীতির বালাই ছিল
না তখন। এ ধরনের জুলুম ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান শ্রমিকরা। শ্রমিকদের প্রবল
আন্দোলনের মুখে ১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ আইন
পাস হয়। কিন্তু সেই আইন কার্যকর না হওয়ায় শিকাগো শহরের মার্কেটের সামনে শ্রমিকরা
১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে তীব্র আন্দোলনের ডাক দেন। আন্দোলনে জীবন দেন বেশ কিছু
শ্রমিক। এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপলাভ করে ৩ ও ৪ মে। আন্দোলনের ফলে শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা
কাজের স্বীকৃতি পান। পরবর্তীকালে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে
পালন করা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালে ২টি গার্মেন্ট কারখানা এবং বারো হাজার ডলার
রপ্তানি আয় দিয়ে শুরু হওয়া গার্মেন্টশিল্প খাতে আজ প্রায় ৫৮০০টি কারখানা স্থাপিত
হয়েছে। প্রায় ৪ মিলিয়ন (৪০ লাখ) শ্রমিক এ শিল্পে এখন যুক্ত আছেন। তবে এ
বিপুলসংখ্যক শ্রমিকদের আজও বাড়তি আয়ের জন্য ১২-১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এখনো মজুরি
বৈষম্য, সুস্থ কর্মপরিবেশের অভাব, কর্মঘণ্টা, বেতন-ভাতার দাবি, নিরাপত্তাসহ
বিভিন্ন দাবিতে শিকাগোর শ্রমিকদের মতোই আন্দোলনে নামতে হয়, রুখে দাঁড়াতে হয় রাজপথ।
নারী নেত্রী ফরিদা আখতার বলেন, ‘এখনো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া
বিভিন্ন জায়গায় নারীদের বেতনের অনেক বৈষম্য আছে। পোশাক খাতে বারবার নারীদের সুস্থ
কর্মপরিবেশের দাবি জানানো হলেও এখনো তা অধরাই রয়ে গেছে। এই গরমে শ্রমিকরা পর্যাপ্ত
বিশুদ্ধ পানি পান করার সুযোগ পান না, গাদাগাদি করে বসে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা
একটানা কাজ করেন। আসলে আমরা শ্রমিক দিবসের সফলতার পথে হাঁটছি, তবে লক্ষ্য এখনো
বহুদূর।’
পৃথিবীতে ২৬টি গার্মেন্ট রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে
সস্তায় শ্রমিকদের পাওয়া যায়। গার্মেন্টশিল্প আমাদের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত।
মোট গার্মেন্ট শ্রমিকের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ১৯৯৮ সালের
এক রিপোর্টে বলা হয়, গার্মেন্ট কারখানায় একজন পুরুষ শ্রমিক নারী শ্রমিকের চেয়ে ৪১
শতাংশ বেশি মজুরি পান। তাদের কোনো যথাযথ নিয়োগপত্র নেই, কাজের নিশ্চয়তা নেই,
মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ভাতা নেই, অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মিত মজুরি নেই, কোনো ক্ষেত্রেই
প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। মজুরির পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা রয়েছেন মারাত্মক
স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও। শ্রমিকদের জন্য যেমন নেই পর্যাপ্ত টয়লেট তেমনি টয়লেট ব্যবহারও
নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা, ক্যান্টিনের
সুবিধা নেই। তবুও নারী গার্মেন্ট শ্রমিকরা নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন দুমুঠো
খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য। বিনিময়ে আমরা মজবুত করছি আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি।
মাসকট গার্মেন্টসের শ্রমিক মাহাবুবা শিরিন বলেন, ‘এমন গরমেও আমগো
দিনরাতে বেশিরভাগ সময় কাডে গোডাউনের মতো ঘরে। আলো বাতাস নাই, এক ফোরে ১১০ জন কাম
করি। গরমে জীবন বাইর হইয়া যায়, বারবার উইঠা পানি খাইতে গেলে কয় কামে ফাঁকি দেই।
তিনডা বাথরুম ব্যবহার করি প্রায় ৫০ জন। সিরিয়ালে থাইক্যা দেরি হইলে হেইডার জন্যও
কথা হুনতে হয়। সুপারভাইজার ধমক দিয়া কয় তোমরা কামে ফাঁকি দেও। তোমগো তাই বেতন কম।’
মাহাবুবার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই গার্মেন্টের অপারেটর তাছলিমা
আক্তার বলেন, ‘আমরা পুরুষ শ্রমিকগো মতোই ডিউটি দেই। ওভারটাইম করি। কিন্তু মাস শেষে
বেতন পাই পুরুষের চেয়ে কম। ধমক ধামও আমরা বেশি খাই। তারপর তো আবার আমগো নিরাপত্তাও
নাই।’
১২টি কারখানার ১০১৩ জন নারীর ওপর এই পরিচালিত মহিলা পরিষদের এক
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ৯৬ শতাংশ নারী শ্রমিকই ভাগাভাগি করে টয়লেট, গোসলখানা
ও রান্নাঘর ব্যবহার করেন। এর মধ্যে প্রতি ২২ জন মিলে একটি টয়লেট ব্যবহার করেন।
সরকারি হিসাবে গার্মেন্ট খাতে ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পাঁচ
বছরে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৫১টি। প্রাণ গেছে ৪৮৮ জনের। ১৯৯৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ১৩
বছরে ১৬৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ২২২ জন শ্রমিক। ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের
মধ্যে পোশাকশিল্প কারখানায় ২১৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২১২টি ভবনধসের ঘটনা
রয়েছে। ২৩টি কারখানার ২৭৫ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ২০১২ সালের নভেম্বরে আশুলিয়ার
তাজরীন গার্মেন্টে ১১৩ জনের প্রাণহানিসহ ১৯৯০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা
৩৮৮ বলে জানা যায় বিজিএমইএ’র তথ্য থেকে। আর রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা
তো হাজারের বেশি। প্রতিবছরই অগ্নিকা-সহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় এ মৃত্যুর মিছিল কেবলই
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
কোথাও কোথাও সামান্য হলেও সার্বিকভাবে গার্মেন্টে কাজের পরিবেশের
উন্নয়ন ঘটেনি। ফলে গার্মেন্ট শ্রমিকদের হতাশা এখনো কাটেনি। অধিকাংশ গার্মেন্টে
এখনো ছোট সিঁড়ি বন্ধ রাখা হয়। নিরাপত্তার ব্যাপারটি এখনো অনেকটা উপেক্ষিত। তবে
বর্তমানে বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টরের কর্মপরিবেশের কিছুটা হলেও উন্নয়ন শুরু
হয়েছে কিন্তু উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের জন্য আরও অনেক দূর যেতে হবে।
শুধু গার্মেন্ট খাতে নয়, কর্মক্ষেত্রে প্রায় সব স্তরেই নারীরা
শিকার হচ্ছেন মজুরি বৈষম্য থেকে শুরু করে নানা ধরনের বৈষম্যের। আসলে মে দিবস
উদযাপন সত্যিকার অর্থে সফল হবে সেদিন যেদিন সব শ্রমিক, সব পেশার শ্রমজীবী তাদের
অধিকার লাভ করবেন। মালিক-ভৃত্য সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন
শ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষ। যাদের শ্রমের ওপর নির্ভর করে সচল রয়েছে আমাদের অর্থনীতি
তাদের অধিকার নিশ্চিত হলেই কেবল মে দিবস পরিপূর্ণভাবে সফলতা লাভ করবে।
গার্মেন্ট খাতে নারী: ঝুঁকি বেশি, কর্মতুষ্টি
কম
পিবিই নিউজ/ই:পোশাক শিল্প খাতের কর্মীরা বাংলাদেশের গার্মেন্ট
সেক্টরের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
চলেছেন। দাবি-দাওয়া, অন্দোলন, সুপারিশ হয়েছে অনেক। তারপরও অনেকের ভাগ্যে জোটে না
মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ভাতা। চাকরি বাঁচানোর জন্যে অসুস্থ শরীরেও কাজ করতে হয়। নেই
পেনশন স্কিমের ব্যবস্থা। উৎপাদন কম হলে সইতে হয় নির্যাতন। অর্থনীতির চাকা যারা সচল
রাখছেন শ্রমে-ঘামে, তাদেরই নেই প্রাপ্য স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা।
ঢাকার সাভারে গ্রিন টেক্সটাইল গার্মেন্টে কাজ করেন নিলুফার ইয়াসমিন
নামের এক নারী শ্রমিক। সারা মাস কাজ করে যে বেতন পান, তা বাবা-মায়ের হাতে তুলে
দেন। নিলুফার বলেন, আমার কোনো প্রয়োজনে স্বামীর কাছে টাকা চাইলে প্রশ্নের মুখোমুখি
হইতে হইত। টাকা দিয়া কী করমু! গার্মেন্টে কাম কইর্যা নিজের পায়ে দাঁড়াইছি। এখন
নিজের দরকারে টাকা খরচ করতে কারও কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না। নিজের ইচ্ছামতো
বাবা-মাকে দেখাশোনা করতে পারি। সন্তানরে লেখাপড়া শিখাইয়্যা একজন ভালো মানুষ হিসাবে
গইড়্যা তোলার স্বপ্ন দেখি। গার্মেন্ট শিল্প মানুষের জীবন বাঁচাইতাছে। সেই
গার্মেন্টে কাজ করি বইল্যা অনেকেই কয় গার্মেন্টে যারা কাজ করে তারা ভালা না। গ্রাম
থাইক্যা শহরে আসছি দুইটা টাকা রোজগারের জন্য। কাজ না করলে সন্তান, বাবা-মায়েরে
দেখমু কেমনে? যারা এসব কথা কয়, তাগো গার্মেন্ট কর্মীগো সম্পর্কে না জাইন্যা, না
বুইঝ্যা কিছু বলা ঠিক না।
তিনি আরও বলেন, গার্মেন্ট যেমন আমাগো জীবন বাঁচাইতাছে, তেমনি অনেক
সমস্যাও আছে। কাম করতে করতে পেরেশান হইয়া পড়ি। ছুটি চাইলে ছুটি পাই না। তিন দিন
কামে না গেলে চাকরি চইল্যা যায়। অসুস্থ শরীরে কাম করতে না পারলে, দুই পিস মাল কম
তৈরি হইলে বলে, তোমার আর কাম করতে হইবো না, গেট খোলা আছে, চইল্যা যাও। পাঁচ-দশ পিস
মাল কম বানাইলে নির্যাতন করে। গার্মেন্টে এর বিচার তো নাই-ই. উল্টা চাকরি চইল্যা
যায়। সুপারভাইজার বলে, ‘কী করতে পারবি, কিছুই করতে পারবি না।’ আমরা অসুস্থ হইলে
মেডিকেলও নাই। গার্মেন্টে কাম করি বইল্যা রাস্তা দিয়া চলাফেরায় নিরাপত্তা নাই।
বেডারা খারাপ দৃষ্টিতে তাকায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলাইয়া কাম কইর্যা টাকা রোজগার
করি, আর মানুষ খারাপ চোখে দেখবো এইটা মোটেও ঠিক না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ‘পোশাক শিল্পে নারীর অবস্থান’
শীর্ষক একটি গবেষণা করা হয়েছিল ২০১৩ সালে। বিজিএমইএ-র সদস্যভুক্ত ঢাকা, গাজীপুর
এবং নারায়ণগঞ্জের ৪৮টি পোশাক কারখানার নির্যাতিত এক হাজার ২৬ জন নারী পোশাক
শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে উল্লে¬খ
করা হয়েছে, শতকরা ৯৭ দশমিক ৩৩ ভাগ মুসলমান এবং শতকরা ৩ ভাগেরও কম হিন্দু নারী
পোশাক-কারখানায় কাজ করেন। তাদের মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগ বিবাহিত। ১৮ বছরের নিচে শতকরা
৮ ভাগ, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে শতকরা ৮৭ ভাগ এবং ৩৫ বছরের ওপরে শতকরা ৫ ভাগ
নারী শ্রমিক বিবাহিত। বিবাহিত নারী শ্রমিকদের এক বা একের অধিক সন্তান রয়েছে।
মাতৃত্বকালীন ছুটি পাননি শতকরা ১৭ ভাগ। অবিবাহিত নারী শ্রমিক শতকরা ৩০ ভাগ। তারা
খুব সকালে কাজে যান এবং রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত কাজ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সামিনা
লুৎফা জানান, শতকরা প্রায় ৮২ ভাগ নারী পোশাক শ্রমিক তাদের বাড়িতে সাপ্লাইয়ের পানি
ব্যবহার করেন। গার্মেন্টে কর্মরত এসব নারী শ্রমিকের মধ্যে শতকরা ৯৭ ভাগ নারীকে
বাথরুম শেয়ার করতে হয়। দেখা গেছে, একটি বাথরুম গড়ে প্রায় ১০ থেকে ২০ এমনকি ৪০ জন
পর্যন্ত ব্যবহার করেন। এর ফলে তাদের মধ্যে নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতা যেমন
ইউটিআই ইনফেকশন ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়। স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। সারাদিন কাজ
শেষে বাসায় ফিরে রান্নার জন্য চারজনের পর অপেক্ষা করতে হয়। শতকরা ৯৮ ভাগ নারী
পোশাক শ্রমিক এভাবে তাদের রান্নাঘর শেয়ার করেন। একজন নারী শ্রমিক কর্মক্ষেত্র ও
বাসস্থানের পরিবেশগত কারণে স্বামী, সন্তান এবং নিজেকে সময় দিতে পারেন না।
এছাড়া অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে তারা প্রোটিন এবং আমিষ জাতীয়
খাদ্য অনেক কম খান। শতকরা ৮৭ ভাগ শাক-সবজি, শতকরা ৯০ ভাগ ঝাল, শতকরা ৮৮ ভাগ স্নেহ
বা চর্বি জাতীয় খাবার, প্রোটিন জাতীয় খাবার ডিম শতকরা ৩১ ভাগ, দুধ শতকরা ৫ ভাগ,
মাংস শতকরা ৪ ভাগ, ফল শতকরা ৫ থেকে ৯ ভাগ এবং মিষ্টি শতকরা ১৭ ভাগ খান। এর ফলে
পুষ্টিগত বিচারে তারা শারীরিকভাবে দুর্বল ও অসুস্থতার পর্যায়ে রয়েছেন। এর অনিবার্য
প্রভাব পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। এত সমস্যা সত্ত্বেও পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিক
বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী
অধ্যাপক ড. জাহিদ চৌধুরী জানান, নিম্ন মজুরি, পুরুষ সহকর্মী কিংবা কর্মকর্তা
কর্তৃক যৌন হয়রানি, অনিয়মিত বেতন থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে ৯০ শতাংশ গার্মেন্ট
কর্মী হলেন নারী। কর্মক্ষেত্রে সুপারভাইজারের হয়রানির কারণে গার্মেন্টে কর্মরত
নারীদের কর্মতুষ্টি কম। পারিবারিকভাবেও তারা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন।
শহরাঞ্চলে অভিবাসী নারীরা নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে
পুষ্টির অভাব, নিম্ন মজুরি, জীবনযাত্রার নিচু মান, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান এবং
স্বাস্থ্যসেবার অভাব। পোশাক শিল্পে অভিগম্যতার ফলে নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক
স্বাধীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এটা ঠিক। যার ফলে তাদের কথা বলা এবং নিজে সিদ্ধান্ত
নেয়ার মত জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু দেখা যায়, নারীরা অধিকাংশ সময় ব্যক্তিগতভাবেও
ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া পর্যন্ত এমনকি
কর্মক্ষেত্রেও নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার অভাব থাকে।
পোশাক শিল্পে নানা সমস্যার পরও নারীরা উপার্জন করে স্বাবলম্বী
হচ্ছেন। বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন পোশাক কর্মীরা। এটা দেশের উন্নয়নে একটা
ইতিবাচক দিক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন,
বাংলাদেশের অনেক ইতিবাচক উন্নয়নের মধ্যে এটি একটি। পোশাকশিল্পে নারী তার জায়গাটি
করে নিয়েছেন। এই শিল্পে শ্রমিক হিসেবে নারীর অভিগম্যতার ফলে তারা আজ কথা বলতে
পারছেন, নিজের জন্য কিছু অর্থ ব্যয় করতে পারছেন। নারীরা আজ দলবেঁধে রাস্তায় হেঁটে
তাদের কর্মক্ষেত্রে যান। নিঃসন্দেহে এটা নারী সমাজের জন্য এক বিশাল অর্জন। এগুলো
সবই পোশাকশিল্পে নারীর অবস্থানের ইতিবাচক দিক। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে নারী-পুরুষের
যে বৈষম্য সমাজে বিরাজমান, তা থেকে নারী বের হয়ে আসতে পারেনি। শ্রমবিভাজনের কারণে
নারী সব সময়ই দ্বিতীয় মাত্রায় অবস্থান করে যাচ্ছে। পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রেও এর
ব্যত্যয় ঘটেনি। নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করার জন্য আমরা সবাই কাজ করে যাব এবং সমাজ
থেকে এই বৈষম্য দূর করে এগিয়ে যাব এই আমাদের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন,
পোশাকশিল্পে বর্তমানে নারীর যে অবস্থান ও অবস্থা, তা নারীর জন্য কিছু কিছু
ক্ষেত্রে ইতিবাচক, আবার অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক। তাই কিছু সমস্যা সমাধানের
মাধ্যমে নারীর অবস্থা ও অবস্থান পরিবর্তন সম্ভব নয়। পোশাক শিল্প-শ্রমিকদের শহর
থেকে দূরে বাসস্থানের ব্যবস্থা করলে তাদের যাতায়াত খরচ এবং শহরের প্রাণকেন্দ্রে
থাকলে বাসা ভাড়ার খরচ অনেক বেড়ে যাবে। গার্মেন্ট এলাকার কাছাকাছি তাদের বাসস্থান
কিংবা যাতায়াত ভাড়ার সুবিধা না দিলে কখনোই এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়।
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে: নারী শ্রমিকদের মূল চিত্রটি বিজিএমইএ ও সরকারের তথ্যে উঠে
আসে না। এই দিকটিতে দৃষ্টি দিতে হবে।
বিজিএমইএ-র সাবেক সভাপতি মো. আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন,
অর্থনীতিবিদ ও তরুণ প্রজন্ম যদি গার্মেন্ট সেক্টরে সম্পৃক্ত থাকেন, তবে গার্মেন্ট
শিল্পের উন্নয়ন হবে। বাংলাদেশে নারী পোশাক শ্রমিকদের যে অবস্থান, তা তাদের
জীবনযাত্রার ব্যয় দিয়ে বিচার করা। নারী শ্রমিকদের মজুরি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাস্তবতার
সঙ্গে মিল রেখে নির্ধারণ করা। নারী পোশাক শ্রমিকদের অবস্থানের পরিবর্তনের জন্য
স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যসব ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। বিজিএমইএ গার্মেন্টে
শিশু শ্রমিক নেয়া নিষিদ্ধ করেছে। যে গার্মেন্টে শিশু শ্রমিক পাওয়া যাবে, তাদের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পোশাককর্মীর সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য সরকারের
সঙ্গে যৌথভাবে বিজিএমইএ পাঁচটি স্কুল খুলেছে। ব্যবস্থা করেছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের
বৃত্তি প্রদানের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন,
পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। অধিকাংশ সময়
তারা ন্যূনতম মজুরি পান না। কারণ সামাজিকভাবে তারা ন্যায়বিচার পান না। বাংলাদেশের
পোশাক খাতে শ্রম আইনের সংস্কার করা দরকার। গার্মেন্টের মূল লাভের শতকরা ৫ ভাগ
শ্রমিকদের জন্য ব্যয় করার কথা থাকলেও তা ব্যয় করা হয় না। নেই পেনশনের ব্যবস্থা।
গার্মেন্ট সেক্টরে পেনশন স্কিম জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর করা প্রয়োজন। নারী
শ্রমিকদের এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে ট্রেড ইউনিয়নের যথাযথ প্রয়োগ ও এর গুরুত্ব
দিতে হবে। নইলে নারী শ্রমিকরা ক্রমাগতভাবেই শাসন ও শোষণের শিকার হবে। -বাসস
৩০ লাখ নারী শ্রমিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার
বাইরে
পোশাক শিল্পের ৩০ লাখ নারী শ্রমিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার বাইরে। শনিবার রাজধানীর রূপসীবাংলা হোটেলে আয়োজিত এক সেমিনারে এ তথ্য জানানো হয়। ‘তৈরী পোশাক শিল্পে নারী কর্মীদের যৌন ওপ্রজনন স্বাস্থ্যসেবা অধিকার এবং করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারটির আয়োজন করে পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ডট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি)। সেমিনারের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পোশাক শিল্পে কর্মরত কিশোরী ওযুবতীর সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এরই সঙ্গে সমান্তরালে বেড়েছে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন।অথচ না জানার কারণে নারী শ্রমিকরা এ ধরনের হয়রানি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না। পাচ্ছেনা প্রতিকার। সেমিনারে বক্তারা নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকার,বিজিএমইএ, বিভিন্ন পেশাজীবী ও বেসরকারি সংস্থাকে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। পিএসটিসি’রপ্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কমান্ডার (অব.) আবদুর রউফের সভাপতিত্বে এ সেমিনারে অংশ নেন শ্রম ওকর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইসরাফিল আলম, বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতিআনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ, নিলুফা চৌধুরী মনি এমপি, ডা. আবদুন নূর তুষার, নারী নেত্রীনাজমা বেগম, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, কমরেড রফিকুজ্জামান রতন, ড. তুহিন মালিক, ডা. আনিসুররহমান, স্থপতি মোবাশ্বের, এনজিও কর্মী রঞ্জন কর্মকার প্রমুখ।
নারী শ্রম দিচ্ছে কিন্তু শ্রমিক
হবার অধিকার পাচ্ছে না –
শ্রমিক হিসেবে নারী স্বীকৃত কিনা, তার
মজুরী বৈষম্য কেন ঘটছে, বা মুল অর্থনীতিতে নারীর ভুমিকা কি সেটা বারে বারে প্রশ্ন
ওঠে, কিন্তু কোন সুরাহা হয় না। কিছুটা পাওনা আদায় করা গেলেও পুরুষ শ্রমিকের সমান
বা আন্তর্জাতিক মানের কোন কাঠামোতে নারীকে ধরা হয় না। অথচ নারী সবসময়ই শ্রমজীবী,
সেটা বাড়ীর ভেতরে হোক বা বাইরে। নারী জন্মের পর থেকে বুঝতে শেখার অংশ হিসেবে তাকে
কম পক্ষে গৃহস্থালি কাজ শিখে রাখতে হয়। নইলে তার যে মূল ঠিকানা, অর্থাৎ শ্বশুর
বাড়ী সেখানে ঠাঁই হবে না। সেটাই তার কর্মস্থল। নারী তাই কখনো বেকার নয়। যদিও সে
বলে আমি কিছু করি না, সংসার দেখি যেন এটা কাজ নয়। এগুলো পুরণো প্রসংগ, তবুও নারী
শ্রমিককে যখন পথে ঘাটে দেখি এবং তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হবার যে যন্ত্রণা দেখি
তখন এই মৌলিক দিকগুলো সামনে চলে আসে। নারীর প্রতি মনোভাব কি আমাদের আদৌ বদলেছে?
আন্তর্জাতিকভাবে নারী অধিকার আন্দোলনের
প্রেক্ষাপট নারীর শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে আগে হয়েছে নাকি নারীর ব্যাক্তি
অধিকারের আলোকে হয়েছে এটা খতিয়ে দেখার বিষয়। নারী আন্দোলনের ইতিহাস তার স্বাক্ষ্য
দেবে। তবে ‘নারীবাদী’ হওয়ার সাথে শ্রমিক নারীর অধিকার সব সময় গুরুত্ব পায় নি।
শ্রমিক নারীর পক্ষে বলার অর্থ সবসময় নারীবাদীতার চরিত্রের মধ্যে পড়ে নি। তার একটি
কারণ হচ্ছে নারীবাদী আন্দোলন বা ফেমিনিজম নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাঁরা নিজেরা
শ্রেণীগতভাবে শ্রমিকের পর্যায়ে পড়েন না। তাঁরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিংবা বর্ণের দিক
থেকেও শ্রমিক নারী থেকে ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রে এই পার্থক্য বোঝা গেছে সাদা ও
মধ্যবিত্ত নারী বনাম কালো ও শ্রমজীবী নারীদের দাবী-দাওয়া ও সংগ্রামের ধরণের
পার্থক্য দেখে। তবে নিঃসন্দেহে ফেমিনিজমের অবদান আছে নারীর ব্যাক্তি অধিকার
প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, যার সুফল নারী শ্রমিকও নিতে পারছে। কিন্তু এই সত্য মেনেই
আমাদের কথা বলতে হচ্ছে যে নারী শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি এখনও মুল শ্রোতের নারী
আন্দোলনের অংশ নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দুঃখজনকভাবে এটাই সত্যি।
বাংলাদেশে নারী মুক্তির চিন্তা চেতনায় বেগম
রোকেয়াও নারীকে পুরোপুরি শ্রমিক হিসেবে দেখেন নি; তিনি দেখেছেন তাঁর সার্বিক
বঞ্চনার অবস্থা, স্ত্রীজাতির অবনতির অবস্থা এবং সেখান থেকে মুক্তির জন্যে নারীকে
প্রস্তুত করতে চেয়েছেন। এই দিক থেকেও তাঁর জন্যে নারীকে কেরাণী হোক বা জজ
ব্যারিস্টার হোক, কিছু একটা হওয়ার স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন। বর্তমানে নারীরা সেই
কাজটি করছেন সফলভাবেই। সার্বিকভাবে নারীকে কর্মক্ষেত্রে আনার বিষয়টি রোকেয়া কখনোই
ভুলে যান নি। সেদিক থেকে বলবো পশ্চিমা নারীবাদের তুলনায় বেগম রোকেয়ার চিন্তা সেই
সময়ের প্রেক্ষিতে অগ্রসর ছিল। অবশ্য বেগম রোকেয়ার সময়কালেই বিভিন্ন দেশে ‘সুঁচ
কারখানার’ বা পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকরা আট ঘন্টা কাজের দাবীতে রাস্তায়
নেমেছিলেন। জানিনা ক্লারা সেৎকিনের চিন্তার সাথে বেগম রোকেয়া জানাজানির কোন সুযোগ
ছিল কিনা। না থাকলেও বেগম রোকেয়া সে চিন্তা থেকে দূরে ছিলেন না মোটেও। সরাসরি
নারীর কর্মঘন্টা বা মজুরী নিয়ে কথা বললেও নারীর শ্রমিক হওয়ার বিষয়টি তার চিন্তায়
ছিল না বলা যাবে না। বেগম রোকেয়া জীবিত থাকাকালীন সময়েই ১৯১৮ সালে আন্তর্জাতিক
নারী দিবস ঘোষিত হয়েছিল শ্রমিক নারী আন্দোলনের দাবীর প্রেক্ষিতেই।
বাংলাদেশের নারী শ্রমিক প্রসংগ আলাদাভাবে
আলোচনার চেয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে করাই ভাল, কারণ বর্তমানে যেসকল বিষয় নারী
শ্রমিকের জন্যে ভাবনা জাগাচ্ছে তার উৎপত্তি এখানে নয়, এর সাথে বিশ্বের অর্থনীতির
সম্পর্ক একেবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর ইতিহাসও আমাদের একটু জানা দরকার।
সত্তুরের দশকে নারী অর্থনীতির আলোচনায়
স্থান পেল এই কারণে যে সে সময় সবুজ বিপ্লব বা আধুনিক কৃষিকে কার্যকর করতে হলে
নারীকে সম্পৃক্ত করতে হয়েছে। যারা আধুনিক কৃষি প্রবর্তন করেছিলেন তাঁরা খুব ভাল
করে জানতেন এই কৃষি ব্যবস্থা নারীকে কর্মহীন করে দেবে। কৃষি কাজে তার যে সরাসরি
ভুমিকা ছিল বিশেষ করে বীজ রক্ষা করা, ফসল ঘরে উঠলে মাড়াই থেকে শুরু করে গোলায় ভরা
পর্যন্ত নারী প্রচন্ড ব্যস্ত। পরিবারের নারী শ্রমের খুব দরকার ছিল। তাই তার কদরও
ছিল। একা কাজ করতে না পারলে এবং ঘরের কাজ করার উপযোগী কন্যা সন্তান না থাকলে
পুত্র সন্তানের বিয়ে দেয়ার চিন্তা করেছে অনেক পরিবার। ছেলের বয়স ১৮ বা ১৯ বছর হলেই
১৫ বা ১৬ বছরে মেয়েকে বউ করে এনেছে, কিংবা স্বামী নিজেই দিত্বীয় বিয়ে করে বসেছে।
মোট কথা ঘরে নারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাই বাল্য বিয়ে ও বহুবিবাহের মতো নারী
বিরোধী কাজও হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। যেটা সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও এই কাজ অর্থনৈতিক
মুল্যায়নে স্থান পায়নি। কিন্তু তাহলে বলা কি যাবে যে আধুনিক কৃষি নারীকে কর্মহীন
করে দিয়ে তাকে মুক্তি দিয়েছে? সোজা উত্তর হচ্ছে, না। বাল্য বিয়ে বা বহু বিবাহও
বন্ধ হয় নি। নারীর প্রয়োজন শুধু সন্তান জন্মদানের বাইরে আর কিছু নেই। তাই নারী
নির্যাতন বেড়েছে, বেড়েছে নারী পাচারসহ আরো অনেক সমস্যা।সার্বিকভাবে নারীর ওপর
নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এইভাবে যে পরিবারের শ্রম দেয়া এবং তার দায়িত্ব ও সিদ্ধান্ত
সব তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। এই পর্যায়ে এসে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ভাবনায় গ্রামীন নারীর
কর্মসংস্থান বা উপার্জন করার ধারণা সৃষ্টি করা হয়। নারী কখনোই বসে ছিল না,
নানাভাবে কাজ করেছে, কিন্তু অর্থনৈতিক কাজের পুরুষতান্ত্রিক সংজ্ঞার কারণে নারীর
অর্থনৈতিক অবদান মূল্যায়ন হয় নি, সেটা পরিসংখ্যানে আনার চেষ্টাও নাই। এই বিষয়গুলো
নিয়ে আজকাল কিছু কথাবার্তা এবং গবেষনা হচ্ছে। নারী উন্নয়নের কাজ যখন থেকে শুরু হোল
তখন নতুন ধ্যানধারণা সৃষ্টি করা হোল এই বলে যে নারীকে দৃশ্যমান, একেবার টাকার অংকে
দেখা যায় এমন করে উপার্জন করতে হবে। গৃহের ভেতরে নারীর কাজকে জাতীয়ভাবে গুরুত্ব
দেয়া এবং অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে মাপার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু জাতীয় অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধিতে নারীর কাজের অবদানকে ধরা হয়নি, এখনো হচ্ছে না। জিডিপিতে নারী এখনো
আদার ব্যাপারী হয়েই থাকলো, তার জন্যে জাতীয় অর্থনীতি একটি বড় জাহাজ। খবর রেখে কাজ
কি!
কারণ হিসেবে একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে নারীর
অর্থনৈতিক কাজ তার পরিবারের জন্যে, দেশের জন্যে নয়। নারীর অর্থনৈতিক অবদানের ফলে
নিঃসন্দেহে পরিবারের খাদ্য যোগান বাড়ে, স্বাস্থ্য রক্ষা হয়, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার
নিশ্চয়তা হয়, বা সংক্ষেপে বলা যায় পরিবারের এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের মৌলিক চাহিদা
মেটানো যায়। তবে অর্থনীতির ভাষায় এটা সমাজকল্যাণমুলক কাজ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড
হিসেবে গুরুত্ব দেয়ার বিষয় নয়। তারা পুরুষের মতো ‘শ্রমিক’ নয়। তারা মুলশ্রোতের
কারখানায় কাজ করে না। কাজেই তাদের কাজের মুল্যায়ন পুরুষের মত ঘন্টা ধরে করার দরকার
নেই। তারা উন্নয়নের সাথে যুক্ত, অর্থনীতির সাথে নয়। অর্থনীতি অনেক বড় ব্যাপার।
নারীর সাধ্য কি তার কাছে পৌঁছায়! নারীকে খুব সহজে অর্থনীতির বাইরে নিয়ে আসা যায়
কারণ তাকে সন্তান উৎপাদন করতে হয় এবং লালন-পালন করতে গিয়ে কর্মজীবনের কয়েকটি বছর
হারাতে হয়। নারী শ্রমিক হলেই মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রশ্ন ওঠে। এটা সমস্যা। বিবাহিত
পুরুষ শ্রমিককে সেই কাজের জন্যে সময় দিতে হয় না। নারীকে শ্রমিক হিসেবে বৈষম্য
জায়েজ করার এটা একটা বড় যুক্তি হিসেবে আনা হয়।
নারীর কাজের কারণে নারীর নিজের জীবনেও কি
ধরণের পরিবর্তন এসেছে তাও দেখা হয়েছে। কারণ শ্রমের সাথে শরীরের সম্পর্ক। শ্রমিকের
প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে তার শারীরিকভাবে কাজ করতে পারার যোগ্যতা। এখানে মাথার চেয়েও
বেশি প্রয়োজন হাত-পা ঠিক থাকা। সেও মেশিনের মতোই, একটি জীবন্ত মেশিন।
এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন নারীর শরীর বিশ্ব
অর্থনীতিতে আরও একটি কারণে গুরুত্বপুর্ণ, সেটা হচ্ছে তার প্রজনন ক্ষমতা। আধুনিক
কৃষি প্রবর্তনের পাশাপাশি উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পরিবার পরিকল্পনার নামে
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিতরণ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একটি আন্তর্জাতিক কর্মসুচির
অংশ হয়েছে। গরিব দেশের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তাই ধনি দেশগুলো উদ্বিগ্ন। জনসংখ্যা
নিয়ন্ত্রণ কর্মসুচি কি করে সফল করা যাবে তার একটি যুক্তিসংগত পথ হিশেবে নারীর
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার তত্ত্ব দেয়া হয়েছিল ১৯৭৪ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা
সম্মেলনে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলন,
বিশ্ব শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রম বিভাগ সম্মেলন (১৯৭৬) সহ নানা ধরণের সম্মেলনে
নারীকে অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বায়নের কারণে তৃতীয় বিশ্বের
বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশের নারীদের সস্তা শ্রম হিসেবে নিয়োগের চাহিদা বেড়েছে।
তার প্রধান উদাহরণ তৈরী পোশাক শিল্প, যার মুল উপকরণ হচ্ছে সস্তা শ্রম। এর আগে আরও
একটি শিল্প রপ্তানীমুখী হবার কারণে সস্তা শ্রম হিশেবে নারীদের ব্যবহার করেছে এবং
এখনো করছ সেটা হচ্ছে চিংড়ি রপ্তানী।
যে কোন শিল্পেই নারী শ্রমিক নিয়োগ হয়
প্রধানত পুরুষের তুলনায় সস্তায় পাওয়া যায় বলে এবং যেহেতু এই নারীদের সামনে কাজের
অনেক ক্ষেত্র খোলা নেই। কৃষি ও শিল্পখাতে নারী শ্রমিক সংখ্যা গত শতাব্দির আশির
দশকে লক্ষ্য করা গেছে। এই সময় গার্মেট শিল্পও প্রসার লাভ করতে শুরু করেছে, নারী
শ্রমিকের সংখ্যা হয়েছে ৮.২% এবং কৃষিতে নারীর কাজের সংজ্ঞার পরিবর্তনের কারণে
হয়েছে ৫৮ শতাংশ। কারণ কৃষি কাজের পাশাপাশি গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন ও এখন কাজ
হিসেবে ধরা হয়েছে।
গার্মেন্ট শ্রমিকের কথায় আসা যাক, কারণ
গার্মেন্ট শিল্পে নারীদের যোগদান যেমন নারীদের শ্রমিক হিসেবে চিহ্নিত করার
ক্ষেত্রে সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, তেমনি শ্রমিক হিসেবে শোষণ
নির্যাতন কতভাবে সইতে হ্য় তাও দেখিয়ে দিয়েছে। এর সাথে বিশ্ব বাজারের সম্পর্ক
একেবারে সরাসরি। শ্রমিকের বেতন বাড়ালে মালিকের মুনাফা কমে যায় এবং বিশ্ব বাজারে
প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। প্রায় ৫ হাজার পোশাক কারখানার মধ্যে অনেক
কারখানায় ন্যূনতম মজুরী কাঠামো এখনও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। দীর্ঘ শ্রমিক
আন্দোলনের পরে ২০১৩ সালের ৪ নভেম্বর শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরী পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা
নির্ধারিত হয়। ঘোষিত মজুরী অনুযায়ী প্রথম গ্রেড ৮ হাজার ৫০০ টাকা। দ্বিতীয় গ্রেড ৭
হাজার টাকা। তৃতীয় গ্রেড ৪ হাজার ৭৫ টাকা। চতুর্থ গ্রেড ৩ হাজার ৮০০ টাকা। পঞ্চম
গ্রেড ৩ হাজার ৫০০ শত ৩০ টাকা। ষষ্ঠ গ্রেড ৩২ শো ৭০ টাকা এবং সপ্তম গ্রেড ৩ হাজার
টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অধিকাংশ কারখানায় ৭ম গ্রেড ছাড়া অন্য কোন গ্রেড অনুসরণ
করা হচ্ছে না। একটি টক শোতে একজন গার্মেন্ট মালিক সমিতির কর্তাব্যাক্তি বলে বস্লেন
বেতন বাড়ালে শিল্প টিকবে না, আর শিল না থাকলে এই নারীদের ‘চাকরানী’ হয়ে থাকতে হবে।
এই হচ্ছে নারী শ্রমিকের প্রতি দৃষ্টি ভঙ্গি। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার
দেয়া হয়নি। বিশেষ করে ইপিজেড-এ কোন ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে না। অন্যদিকে ট্রেড
ইউনিয়ন গঠন করা না গেলে যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
পোশাক শিল্পের মালিকেরা ট্রেড ইউনিয়নকে শিল্পের জন্য ক্ষতিকর মনে করেন। এখন
পর্যন্ত ৪ হাজারেরও বেশী প্রতিষ্ঠান ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে রয়েছে বলা হচ্ছে।
গার্মেন্ট শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট
ভুমিকা রাখলেও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ হচ্ছে খুবই কম। বড় বড় কয়েকটি দুর্ঘটনা
হয়ে যাবার পর বিশ্বের ধনি দেশের ক্রেতাদের সংগঠন অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স কাজের
পরিবেশ নিয়ে উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছে এবং নিজেরাই তদারকী করে যাচ্ছে। এটা দেশের জন্যে
ভাল নয়, কিন্তু গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা তাদের কথা শুনে কিন্তু শ্রমিকের দাবী
মানে না। সম্প্রতি ইপিজেড অঞ্চলে শ্রমিকদের জন্যে শ্রমিক কল্যাণ সংস্থা করার
প্রস্তাব মন্ত্রী পরিষদ সভায় অনুমোদন পেয়েছে। এই সংস্থা শ্রমিকের সমস্যা সমাধান
করবে কিন্তু তাকে শ্রমিক হিসেবে নিজের দাবী তোলার বা সংগঠিত ভাবে কাজ করার জন্যে
ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেবে না। বোঝাই যাচ্ছে, শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার জন্যে
এই সংগঠন করা হচ্ছে না।
অন্যদিকে নারী শ্রমিকের প্রজনন ক্ষমতার ওপর
সরাসরি হস্তক্ষেপের উদ্যোগ নিচ্ছে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, তাদের
উন্নত প্রজনন সেবা দেয়ার নাম করে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি, বিজিএমইএ ভবনে শ্রমিকদের
উন্নত প্রজনন সেবা বিষয়ে সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও এনজেন্ডারড হেলথ
বাংলাদেশ (ইএইচবি) নামের একটি সংস্থার সঙ্গে বিজিএমইএর একটি চুক্তি হয়।এই চুক্তি
অনুযায়ি পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের জন্য উন্নত পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন
স্বাস্থ্য এবং সরাসরি পরিবার পরিকল্পনা উপকরণাদি পাওয়া সহজলভ্য করা হবে। প্রায় ৭০%
নারী শ্রমিকের সংগঠনের সাথে এই চুক্তির সুফল কি নারী শ্রমিক পাবে নাকি তাকে সন্তান
জন্মদান থেকে বিরত রেখে মালিক পক্ষকে সহায়তা করা হচ্ছে। এই নারীদের নিজের ইচ্ছায়
পদ্ধ্বতি গ্রহণ সম্ভব হবে কিনা সেটা প্রশ্নবোধক থেকে যাচ্ছে কারণ চুক্তি হচ্ছে
বিজিএমইএ-র সাথে কোন শ্রমিক সংগঠনের সাথে নয়।
।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন